Sunday 13 October 2013

গাভীর খামার ব্যবস্থাপনা


বাংলাদেশে প্রতিবছর দুধের চাহিদা ১২•৫২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে প্রতিবছর ২•২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ঘাটতি প্রতিবছর ১০•২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। চাহিদার আলোকে আমাদের দেশে ছোট-বড় প্রায় ৪৭,৭১০টি ডেইরি খামার গড়ে উঠেছে। বর্তমানে শংকর জাতের গাভী পালনের মাধ্যমে দুগ্ধ খামার স্থাপন একটি লাভজনক ব্যবসা। ফলে গাভী পালনে উন্নত ব্যবস্থাপনা, সঠিক প্রজনন, সুষম খাদ্য, রোগদমন ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে খামারিদের জানা প্রয়োজন।
ভালজাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য-
মাথাঃ হালকা ও ছোট আকার, কপাল প্রশস্তô, উজ্জ্বল চোখ, খাদ্যের প্রতি আগ্রহ।
দৈহিক বৈশিষ্ট্যঃ দেহের সামনে দিক হালকা, পিছনের দিক ভারী ও সুসংগঠিত, দৈহিক আকার আকর্ষণীয়, শরীরের গঠন ঢিলা।
পাজরঃ পাজরের হাড় স্পষ্ট, হাড়ের গঠন সামঞ্জস্যপুর্ণ।
চামড়াঃ চামড়া পাতলা, চামড়ার নীচে অহেতুক চর্বি জমা থাকবে না, চামড়ার রঙ উজ্জ্বল, লোম মসৃণ ও চকচকে হবে।
ওলানঃ ওলান বড় সুগঠিত ও দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, বাটগুলো একই আকারের হবে। চারবাট সমান দূরত্বে ও সমান্তরাল হবে। দুগ্ধশিরাঃ দুগ্ধশিরা মোটা ও স্পষ্ট, তলপেটে নাভীর পাশ দিয়ে দুগ্ধশিরা আঁকাবাঁকাভাবে বিস্তৃত থাকবে।

খামার ব্যবস্থাপনাঃ খামার ব্যবস্থাপনা এক প্রকার কৌশল যার মাধ্যমে খামারের সম্পদ, সুযোগ ও সময়ের সমন্বয় ঘটানো যায়। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার সুফল হল- ১• সম্পদের মিতব্যয়িতা ২• স্বল্প সময়ে ফললাভ ৩• স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন ৪• শক্তি ও শ্রমের অপচয় রোধ ৫• উৎপাদনে গুণগতমান ও উৎকর্ষতা লাভ।

সাধারণ ব্যবস্থাপনাঃ গাভী তার গুণগতমান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে। কিন্তু গাভীর বংশানুক্রমিক গুণগতমান যতই ভাল হোক এর ব্যবস্থাপনা সমন্ধে বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। দৈনন্দিন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, বিজ্ঞান সম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্য সরবরাহ, সঠিক প্রজনন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নত গাভী পালনের মৌলিক বিষয়।

বাসস্থানঃ পারিবারিক পর্যায়ে বা খামার পর্যায়ে গাভী পালন করতে হলে গাভীর জন্য ভাল বাসস্থান প্রয়োজন। গাভীকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম এবং অন্যান্য নৈসর্গিক দৈব দুর্বিপাক, পোকামাকড়, চোর, বন্য-জীবজন্তু হতে রক্ষা করার জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান বা গোয়ালঘর প্রয়োজন। আমাদের আবহাওয়ার আলোকে ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের জন্য ঘরটি উত্তর-দক্ষিণমুখী হওয়া বাঞ্চনীয়। কোন অবস্থাতেই যেন ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা যেন না থাকে। এতে ঘরের মেঝেটি ইট বিছানো থাকলে ভাল হয়। ঘরের দুর্গন্ধ ও মশামাছি দমনের জন্য মাঝে মাঝে জীবাণুনাশক দ্বারা ধোয়া প্রয়োজন।

গবাদিপশুর বাসস্থান দুই ধরণের হতে পারেঃ ১• উন্মুক্ত বা উদাম ঘর ২• বাঁধা ও প্রচলিত ঘর।

বাঁধা ঘরের বৈশিষ্ট্যঃ এই পদ্ধতিতে গরুর গলায় দড়ি বা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে পালন করা যায়। গাভীর খাদ্য, পানি গ্রহণ এবং দুধ দোহন একই স্থানে করা যায়।

সুবিধাঃ বাঁধা থাকে বিধায় গাভীর দুধ দোহন সহজ হয়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় পশু নিরাপদ থাকে, কৃত্রিম প্রজননের জন্য বেশ সুবিধাজনক, নির্ধারিত অল্প জায়গায় পশু পালন করা যায়।

অসুবিধাঃ এই পদ্ধতিতে ঘর তৈরি খরচ বেশি, পশুর সহজে ঘোরাফেরার ব্যবস্থা থাকে না, এতে পশুর ব্যয়াম না হওয়াতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে, একই জায়গায় দিনরাত্রি বাঁধা থাকে বলে মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকে।

বাঁধা ঘরের নকশাঃ এই পদ্ধতির গো-শালায় পশু সব সময় বাঁধা অবস্থায় থাকে। এজন্য গো-শালা যাতে সহজে পরিস্কার করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঘর তৈরি করা প্রয়োজন। প্রচলিত গো-শালা দুই ধরনের হয়-

একসারি বিশিষ্ট গো-শালাঃ অল্প সংখ্যক গবাদি পশুর জন্য একটি লম্বা সারিতে বেঁধে পালনের জন্য এই গো-শালা তৈরি করা হয়। প্রতিটি পশুকে পৃথক রাখার জন্য জিআইপাইপ দিয়ে পার্টিশন দেয়া হয়, পার্টিশনের পাইপ লম্বায় ৯০ সে•মি• এবং উচ্চতায় ৪৫ সে•মি• হওয়া প্রয়োজন, একটি গরুর দাঁড়াবার স্থান ১৬৫ সে•মি•, পাশের জায়গা ১০৫ সে•মি•, খাবার পাত্র ৭৫ সে•মি• এবং নালা ৩০ সে•মি• হওয়া প্রয়োজন, একই মাপে পশুর সংখ্যা অনুযায়ী জায়গা নির্ধারণ করে গো-শালা তৈরি করা হয়, গো-শালা হবে একচালা বিশিষ্ট ঘর, ঘরের ছাদ প্রায় ৩০০ সে•মি• উঁচুতে করতে হয়।

দুই সারি বিশিষ্ট গো-শালাঃ অল্প জায়গায় অধিক পশুপালনের জন্য এ ধরণের গো-শালা তৈরি করা হয়, এ ধরনের গো-শালায় পশুকে দুভাবে রাখা যায়, মুখোমুখি পদ্ধতি ও বাহির মুখ পদ্ধতি। মুখোমুখি পদ্ধতিতে দুই সারি পশু সামনাসামনি থাকে। দুইসারি খাবারের পাত্রের মাঝখানে ১২০ সে•মি• চওড়া রাস্তôা থাকে- যা পাত্রে খাবার দেবার জন্য ব্যবহার করা হয়, একটি গরুর জন্য দাঁড়ানোর জায়গা ৫•৫ ফুট, পাশের জায়গা ৩•৫ ফুট।

সুবিধাঃ একই সাথে দুইসারি পশুকে সহজে খাবার ও পানি সরবরাহ করা যায়, দুধ দোহনের জন্য অধিকতর আলো পাওয়া যায়, পশু নিজ জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, পরিচর্যাকারী সহজে চলাফেরা করতে পারে।

একটি গাভীকে নিম্ন তালিকা অনুসারে খাদ্য সরবরাহ করতে হবেঃ কাঁচা ঘাস (সবুজ ঘাস) ২০-৩০ কেজি, দানাদার খাদ্য মিশ্রণঃ ১৮-২০% প্রোটিন সমৃদ্ধঃ ১ম ৩ কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য- ০৩ কেজি, পরবর্তী প্রতি কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য-০•৫ কেজি, লবণ-৫০-৬০ গ্রাম, পরিস্কার পানি-প্রয়োজন মত।

পরিচর্যাঃ গাভীর সঠিক পরিচর্যা না করলে উন্নত জাতের গাভী পালন করেও গাভীকে সুস্থ সবল উৎপাদনক্ষম রাখা সম্ভব হবে না। ফলে গাভী হতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ দুধ, মাংস পাওয়া যাবে না এবং গাভী পালন অলাভজনক হবে।

দুধ দোহনঃ গাভীর দুধ দৈনিক ভোরে একবার এবং বিকালে একবার নির্দিষ্ট সময়ে দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের পূর্বে গাভীর উলান ও দোহনকারীর হাত পরিস্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

প্রজননঃ গাভীর বংশানুক্রমিক গুণগতমান উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পিত প্রজনন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যে ষাড়ের মা, দাদী, নানী যত বেশি পরিমাণ দুধ দেয় তার বাচ্চার দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা ততই বেশি হয়। তাই যখন গাভী গরম হবে তখন গুণগতমানসম্পন্ন ষাড়ের বীজ দ্বারা নিকটস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র হতে গাভীকে প্রজনন করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

খামারের রেকর্ড সংরক্ষণঃ খামারের লাভক্ষতি নিরূপণ আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাবের উপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিয়য়ে মূল্যায়ন করা দরকার। খামারের উৎপাদিত পণ্যের হিসাব, ক্রয়, বিক্রয়, জন্ম, মৃত্যু এবং কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমের জন্য সঠিক তথ্য রক্ষাকল্পে রেকর্ড সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়।

উন্মুক্ত বাসস্থানে নিম্নোক্ত হারে জায়গার প্রয়োজনঃ

পশুর ধরণ ঘরে প্রতি পশু স্থান প্রতি পশুর জন্য মুক্ত স্থান খাদ্যপাত্র
বাড়ন্ত বাছুর ২•৫-৩ বর্গ মিটার ৫-৬ বর্গ মিটার ৩৭-৫০ সেন্টিমিটার
গাভী ৩-৩•৫ বর্গ মিটার ৮-১০ বর্গ মিটার ৫০-৬০ সেন্টিমিটার
গর্ভবতী গাভী ১০-১২ বর্গ মিটার ১৮-২০ বর্গ মিটার ৬০-৭০ সেন্টিমিটার

-কৃষিবিদ সোহরাব জিসান

No comments:

Post a Comment